বিভিন্ন সময়ে “২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিল রোজা রেখে খেলেছিলেন” শীর্ষক শিরোনামের একটি তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।
উক্ত দাবিতে ২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।

একই দাবিতে বিগত বছরগুলোয় ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন –

একই দাবিতে গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন দেখুন – বার্তা২৪, যুগান্তর, নয়াদিগন্ত।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে মেসুত ওজিল রোজা রেখে মাঠে নামেননি বরং বিশ্বকাপ চলাকালীন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সে বছর রোজা না রাখার কথা জানান। তাছাড়া, ইসলামের জন্য ওজিলের জার্মান দল ছাড়ার তথ্যটিও সঠিক নয়।।
কিওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদমাধ্যমেই ওজিল রোজা রেখে ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো খেলেছেন এমন দাবির পক্ষে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
যেভাবে অনুসন্ধান
ফুটবলের বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে ব্রাজিলে ১৩ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত হয়েছিল ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের ২০তম আসর। একই বছরের ২৮ জুন ব্রাজিলে রমজান মাস শুরু হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জার্মানীর বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয় ১৬ জুন পর্তুগালের বিপক্ষে। এরপর ২১ এবং ২৬ জুন আরো দুইটি গ্রুপ পর্বের ম্যাচ খেলেছে দলটি। রমজান মাস শুরুর আগে এই তিনটি ম্যাচই খেলেছে জার্মানী৷ ২৮ জুন রমজান মাস শুরুর পর জার্মানী প্রথম মাঠে নামে ১ জুলাই রাউন্ট অফ সিক্সটিন, মুসলিম দেশ আলজেরিয়ার বিপক্ষে। এরপর দলটি কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল এবং ফাইনাল খেলেছে রমজান মাস চলাকালে। অর্থাৎ, সেবার জার্মানী রমজান মাস চলাকালীন মোট চারটি ম্যাচ খেলেছে।
রিউমর স্ক্যানার টিম ভিন্ন ভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে জাতীয় দৈনিক ‘The Daily Star’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৪ সালের ২৯ জুন আলজেরিয়ার বিপক্ষে রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচকে সামনে রেখে “Ozil won’t be fasting” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ওজিল জানিয়েছেন, বিশ্বকাপের কারণে সে বছর তার পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব হচ্ছে না।”

তাছাড়া, পরদিন বিবিসি বাংলা’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও ওজিলের বরাতে একই তথ্য উল্লেখ করা হয়।

অধিকতর অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম ২০১৪ সালের ২৮ জুন খেলাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘Yahoo Sports’ এর ওয়েবসাইটে “Ramadan poses a challenge to some World Cup players” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচকে সামনে রেখে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসে মেসুত ওজিল জানিয়েছেন, “তিনি এ বছর রমজানে অংশ নেবেন না। “

সংবাদ সম্মেলনটির সূত্র খুঁজতে গিয়ে পরবর্তীতে ইউটিউবে ‘German Football’ নামক একটি চ্যানেলে “Mesut Özil at press conference during World Cup in Brazil” শিরোনামে একটি ভিডিওর হদিস পায় রিউমর স্ক্যানার টিম।
অফিশিয়াল কিংবা নির্ভরযোগ্য কোনো ইউটিউব চ্যানেল না হলেও সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের করা প্রশ্ন এবং ওজিলের দেওয়া উত্তর বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার নিশ্চিত হয়েছে এটি ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ওজিলের সংবাদ সম্মেলনেরই ভিডিও। যেমন, সংবাদ সম্মেলনে আগের ম্যাচে ঘানার বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে (ভিডিওর ১৩তম সেকেন্ড সময়ে)। ফিফার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ম্যাচের আগে ঘানার বিপক্ষেই ২১ জুন মাঠে নেমেছিল জার্মানী। তাছাড়া, পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে মাঠে নামার প্রসঙ্গটিও এসেছে (ভিডিওর ২৫তম সেকেন্ড সময়ে) সংবাদ সম্মেলনে। ফিফার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মাঠে নেমেছিল জার্মানী।
অর্থাৎ, সংবাদ সম্মেলনটি ২০১৪ সালের ২৫ জুনের।

ভিডিওর ৬ মিনিট ১৪ সেকেন্ড সময়ে দেখা যায়, একজন সাংবাদিক ওজিলকে জিজ্ঞেস করছেন, “শনিবার (২৮ জুন) রমজান শুরু হবে। এটি কি আপনার উপর, আপনার ট্রেনিং, আপনার নিউট্রিশনের উপর কোনো প্রভাব ফেলবে? জার্মান ফুটবল এসোসিয়েশন (DFB) এর সাথে এই ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়েছে? নাকি এটা আপনাকে মোটেও স্পর্শ করে না?”
জবাবে ওজিল বলেন, “বিষয়টি হচ্ছে আমি কাজ করছি (I am working) এবং আপনি এখানকার (আবহাওয়ার) অবস্থা দেখছেন। এখানে খুবই গরম। রমজান শনিবার (২৮ জুন) শুরু হবে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি অংশ নিতে পারছি না। কারণ আমি কাজ করছি এবং এটি প্রশ্নের বাইরে।
অর্থাৎ, মেসুত ওজিল ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে রোজা রেখে কোনো ম্যাচ খেলেননি।
ওজিল কি ইসলামের জন্য অবসরে গেছেন?
“ইসলামের জন্য ওজিল জার্মান দল ছেড়েছেন” শীর্ষক একটি দাবিও গেল কয়েক বছর ধরে ইউটিউব ও ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।
ইউটিউবে প্রকাশিত এমন দুইটি ভিডিও দেখুন – এখানে এবং এখানে।
আর্কাইভ ভার্সন দেখুন – এখানে এবং এখানে।
ফেসবুকে প্রকাশিত এমন দুইটি পোস্ট দেখুন – এখানে এবং এখানে।
আর্কাইভ ভার্সন দেখুন – এখানে এবং এখানে।
রিউমর স্ক্যানারের টিম অনুসন্ধান করে দেখেছে, এই দাবিটিও সঠিক নয়।
অনুসন্ধানে ‘বিবিসি বাংলা’র ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই “জিতলে আমি জার্মান, হারলে বিদেশি’: জার্মানিতে বর্ণবাদের অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর তুর্কী বংশোদ্ভূত ফুটবলার মেসুত ওজিলের” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “জার্মানিতে ‘বর্ণবাদ এবং অসম্মানের’ শিকার হয়েছেন এই অভিযোগ তুলে তুর্কী বংশোদ্ভূত জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিল আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। লন্ডনে গত মে মাসের এক অনুষ্ঠানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে ছবি তোলার পর জার্মানিতে তীব্র সমালোচনা হয় ইংলিশ ফুটবল ক্লাব আর্সেনালের ২৯ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার। মেসুত ওজিল বলেছেন, একারণে অনেকে তাকে হুমকি ধামকি দিয়েছেন, তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে তাকে অনেকে ইমেইল করেছেন এবং রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের শুরুতেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ার জন্যে তাকে দায়ী করেছেন।”

তাছাড়া, সে সময় ওজিলের এ সংক্রান্ত একটি টুইটেও ইসলাম প্রসঙ্গে কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, ইসলামের জন্য ওজিল জার্মান দল ছাড়েননি।
মূলত, ব্রাজিলে ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিল রোজা রেখে ম্যাচ খেলেছিলেন শীর্ষক একটি দাবি বিগত কয়েক বছর ধরেই গণমাধ্যম ও ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে উক্ত বিশ্বকাপ চলাকালীন ওজিলের একটি ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলন খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে ওজিল বলেন, সে সময় ব্রাজিলে অতিরিক্ত গরম থাকায় সে বছর তিনি রোজা রাখছেন না। অর্থাৎ, ২০১৪ ফুটবল বিশ্বকাপে ওজিলের রোজা রেখে ম্যাচ খেলার দাবিটি সঠিক নয়। তাছাড়া, ইসলামের জন্য নয়, বরং জার্মানিতে ‘বর্ণবাদ এবং অসম্মানের’ শিকার হয়ে ২০১৮ সালে জাতীয় দল থেকে অবসর নেন ওজিল।
উল্লেখ্য, জার্মানির জার্সিতে ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত খেলেছেন ওজিল। ৯ বছরের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারে ম্যাচ খেলেছেন ৯২। ৯২ ম্যাচে করেছেন ২৩ গোল আর অ্যাসিস্ট করেছেন ৪০ গোলে।
প্রসঙ্গত, চলমান কাতার ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে একাধিক গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিল রোজা রেখে খেলেছিলেন এবং ইসলামের জন্য ওজিল জার্মান দল ছাড়েন শীর্ষক দুইটি দাবি প্রচার হয়ে আসছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।